সনাতন (হিন্দু) ধর্মের ইতিহাস

সনাতন (হিন্দু) ধর্মের ইতিহাস

সনাতন ধর্ম, যা সাধারণত হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত, বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগুলির মধ্যে একটি। এর ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। সনাতন ধর্মের উৎপত্তি এবং বিকাশ ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটেছে। এই ধর্মের মূল ভিত্তি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত (যার মধ্যে ভগবদ্গীতা অন্তর্ভুক্ত) এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলির উপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রাচীন ইতিহাস

1. **সিন্ধু সভ্যতা (প্রায় ৩৩০০-১৩০০ BCE)**: – সিন্ধু সভ্যতায় কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে যা হিন্দু ধর্মের প্রাথমিক রূপের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। যেমন, পশুপতি শিবের মূর্তি এবং ধ্যানমগ্ন ব্যক্তির ছবি।

2. **বৈদিক যুগ (প্রায় ১৫০০-৫০০ BCE)**: – বৈদিক যুগে বেদ রচিত হয়, যা হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ। এই যুগে যজ্ঞ, হোম এবং বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল। – ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ এই যুগের প্রধান গ্রন্থ।

3. **উপনিষদীয় যুগ (প্রায় ৮০০-২০০ BCE)**: – উপনিষদে আত্মা, ব্রহ্ম এবং মোক্ষের ধারণা গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে। এই যুগে দার্শনিক চিন্তাভাবনা এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের বিকাশ ঘটে।

মধ্যযুগীয় ইতিহাস

1. **পুরাণ ও ইতিহাস যুগ (প্রায় ৫০০ BCE-৫০০ CE)**: – এই যুগে পুরাণ রচিত হয়, যেখানে বিভিন্ন দেবদেবীর কাহিনী, মহাকাব্য (রামায়ণ ও মহাভারত) এবং ধর্মীয় রীতিনীতি বর্ণিত হয়েছে। – ভগবদ্গীতা, যা মহাভারতের অংশ, এই যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ।

2. **মধ্যযুগ (প্রায় ৫০০-১৫০০ CE)**: – এই সময়ে ভক্তি আন্দোলনের বিকাশ ঘটে, যেখানে ব্যক্তিগত ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়। – আদি শঙ্কর, রামানুজ, মাধব, চৈতন্য মহাপ্রভু প্রমুখ ধর্মগুরুদের আবির্ভাব ঘটে।

আধুনিক যুগ

1. **ঔপনিবেশিক যুগ (প্রায় ১৫০০-১৯৪৭ CE)**: – ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু ধর্মে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। রামমোহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ সংস্কারকদের আবির্ভাব ঘটে। – এই সময়ে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দর্শন এবং অনুশীলন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়।

2. **স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ (১৯৪৭-বর্তমান)**: – ভারতের স্বাধীনতার পর হিন্দু ধর্ম একটি বৈশ্বিক ধর্ম হিসেবে বিকশিত হয়। বিশ্বজুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রসার ঘটে। – আধুনিক যুগে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, যেমন বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, শাক্তধর্ম ইত্যাদি, তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও অনুশীলন বজায় রেখেছে।

হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য 

**বহুদেববাদ ও একেশ্বরবাদ**: হিন্দু ধর্মে একাধিক দেবদেবীর উপাসনা করা হয়, কিন্তু অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন যে সমস্ত দেবদেবী একই সর্বোচ্চ সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ।

**কর্ম ও পুনর্জন্ম**: হিন্দু ধর্মে কর্মফল এবং পুনর্জন্মের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

**মোক্ষ**: জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল মোক্ষ বা মুক্তি, যা জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভ। সনাতন (হিন্দু) ধর্মের দেবদেবীদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী, এবং সরস্বতী। এই দেবদেবীরা হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দিক এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে প্রতিফলিত করে, যা তাদের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

  • ব্রহ্মা

ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টির দেবতা, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে ব্রহ্মা সমস্ত জীবের সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি চারটি বেদ রচনা করেছেন। তাঁর চারটি মুখ চারটি বেদের প্রতীক, যা জ্ঞান এবং সৃষ্টির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • বিষ্ণু

বিষ্ণু হলেন সংরক্ষণ এবং রক্ষার দেবতা। তিনি পৃথিবী এবং তার সমস্ত জীবকে রক্ষা করেন এবং ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অবতারের মাধ্যমে ধরাধামে অবতীর্ণ হন। বিষ্ণুর দশটি প্রধান অবতারের মধ্যে রাম, কৃষ্ণ, এবং বুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। বিষ্ণু বিশ্বাসীদের মধ্যে অত্যন্ত পূজনীয় এবং তিনি সৃষ্টির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য পরিচিত।

  • শিব

শিব হলেন ধ্বংস এবং রূপান্তরের দেবতা। তিনি ত্রিশূল এবং ডমরু ধারণ করেন এবং তাঁর নৃত্য তাণ্ডব সমস্ত সৃষ্টির এবং ধ্বংসের প্রতীক। শিবের ধ্যানমগ্ন মূর্তি এবং তাঁর ধ্যানের গুরুত্ব হিন্দু ধর্মে অতি মূল্যবান।

  • দেবী দুর্গা

দুর্গা হলেন শক্তির দেবী এবং তিনি মহিষাসুরমর্দিনী নামে পরিচিত, যিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। দুর্গা দেবীর দশ হাত এবং তিনি বিভিন্ন অস্ত্র ধারণ করেন, যা তাঁকে শক্তি এবং সাহসের প্রতীক হিসেবে ফুটিয়ে তোলে।

  • লক্ষ্মী

লক্ষ্মী হলেন ধন-সম্পদ এবং সৌভাগ্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী এবং হিন্দু গৃহস্থালিতে অত্যন্ত পূজনীয়। লক্ষ্মীর আশীর্বাদে ধন-সম্পদ এবং শান্তি আসে বলে বিশ্বাস করা হয়।

  • সরস্বতী

সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সঙ্গীত, এবং শিল্পকলার দেবী। তিনি ব্রহ্মার কন্যা এবং পূজনীয় দেবী হিসেবে বিদ্যা এবং সৃজনশীলতার উৎস। সরস্বতীর আশীর্বাদে বিদ্যা এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে।

এভাবে, সনাতন ধর্মের দেবদেবীরা হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দিক এবং জীবনের বিভিন্ন স্তরকে প্রতিফলিত করে, যা তাদের গুরুত্বকে অসীম করে তোলে।

সনাতন ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও মতবাদ

সনাতন ধর্মের ভেতরে বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং মতবাদ রয়েছে, যা ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা এবং প্রথাগত কার্যাবলীর ভিন্নতায় পরিপূর্ণ। প্রধান সম্প্রদায়গুলির মধ্যে শৈব, বৈষ্ণব এবং শাক্ত সম্প্রদায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অনুশীলন রয়েছে যা তাদের অনন্য করে তোলে।

শৈব সম্প্রদায় হল শিবের উপাসক, যারা শিবকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসেবে মানেন। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে শৈব দর্শন, যোগ এবং তন্ত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শৈবরা শিবলিঙ্গের পূজা করেন এবং মহাশিবরাত্রি উৎসব বিশেষভাবে উদযাপন করেন। শৈব সম্প্রদায়ের উপাসনার মূল লক্ষ্য হল মুক্তি বা মোক্ষ প্রাপ্তি।

বৈষ্ণব সম্প্রদায় বিষ্ণুর উপাসক, যারা বিষ্ণুকে সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে মানেন। বৈষ্ণব ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে ভাগবত গীতা এবং রামায়ণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণ এবং রামের পূজা করেন এবং বিভিন্ন উৎসব যেমন জন্মাষ্টমী এবং রাম নবমী উদযাপন করেন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মূল ধর্মীয় অনুশীলন হল ভক্তি বা ভক্তি যোগ, যা ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও সেবা মাধ্যমে মুক্তি প্রাপ্তির চেষ্টা করে।

শক্তি বা শাক্ত সম্প্রদায় শক্তি বা দেবীর উপাসক, যারা দেবী দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর পূজা করেন। শাক্ত সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস তন্ত্র এবং যোগ দর্শনে ভিত্তিক। দেবী দুর্গার পূজা করার সময় দুর্গাপূজা এবং কালীপূজা বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। শাক্ত সম্প্রদায়ের প্রধান লক্ষ্য হল শক্তির মাধ্যমে আত্মার মুক্তি বা মোক্ষ প্রাপ্তি।

এইভাবে সনাতন ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং মতবাদের মেলবন্ধন, যা ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রথার বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপের প্রতিফলন। প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় অনুশীলন এবং উৎসব রয়েছে, যা সনাতন ধর্মের ঐশ্বর্যকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সহায়ক।

সনাতন ধর্মের তীর্থস্থান ও পূণ্যভূমি

সনাতন ধর্মের তীর্থস্থান ও পূণ্যভূমিগুলি ধর্মীয় গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই স্থানগুলি সাধারণত ভক্তদের জন্য আধ্যাত্মিক বিশ্রামস্থল হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে এবং পবিত্রতার অভিজ্ঞতা লাভ করে।

কাশী, যা বারাণসী নামেও পরিচিত, হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। এটি ভগবান শিবের পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় এবং গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। কাশীতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত গঙ্গায় স্নান করে এবং বিশ্বনাথ মন্দিরে পূজা অর্চনা করে। মথুরা ও বৃন্দাবন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান ও লীলাভূমি হিসেবে খ্যাত। মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির এবং বৃন্দাবনে ব্যাংকেবিহারি মন্দির ভক্তদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়।

অযোধ্যা, ভগবান রামের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত, হিন্দুধর্মে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানকার রাম জন্মভূমি মন্দির এবং সরযূ নদীতে স্নান ভক্তদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় কার্যক্রম। এছাড়াও হরিদ্বার, রিষিকেশ এবং পুরী অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান হিসেবে উল্লেখযোগ্য। হরিদ্বার এবং রিষিকেশ গঙ্গার তীরে অবস্থিত এবং গঙ্গায় স্নান ভক্তদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পুরী ভগবান জগন্নাথের মন্দিরের জন্য খ্যাত এবং এখানে বার্ষিক রথযাত্রা উৎসব ভক্তদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।

প্রতিটি তীর্থস্থানে ভ্রমণ ও পূজা পদ্ধতি নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। ভক্তরা সাধারণত পবিত্র স্নান, পূজা, অর্ঘ্য প্রদান এবং ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে তাদের আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। এই তীর্থস্থানগুলি শুধু ধর্মীয় নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

সনাতন ধর্মের উৎসব ও অনুষ্ঠান

সনাতন ধর্মের উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধশালী। এই ধর্মের প্রধান উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম দীপাবলী, হোলি, নবরাত্রি, এবং রথযাত্রা। প্রতিটি উৎসবের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক কাহিনি, যা সনাতন ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

দীপাবলী, যা “প্রদীপের উৎসব” নামেও পরিচিত, সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎসব। দীপাবলীতে লক্ষ্মী দেবীর পূজা করা হয় এবং বাড়ি-ঘর আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়। এই উৎসবটি সাধারণত পাঁচ দিনব্যাপী উদযাপন করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ধনতেরস, নারক চতুর্দশী, লক্ষ্মী পূজা, গোবর্ধন পূজা এবং ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।

হোলি, “রঙের উৎসব”, সনাতন ধর্মের আরেকটি প্রধান উৎসব। বসন্তের আগমনের সাথে সাথে এই উৎসব উদযাপিত হয়। হোলির দিন মানুষ একে অপরের উপর রঙ ছিটিয়ে এবং বিভিন্ন মিষ্টান্ন খেয়ে আনন্দ করে। এই উৎসবের পেছনে রয়েছে প্রহ্লাদ এবং হোলিকার কাহিনি, যা সনাতন ধর্মের ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রতীক।

নবরাত্রি, “নয় রাতের উৎসব”, মা দুর্গার পূজায় নিবেদিত। এই উৎসবটি বছরে দুবার উদযাপিত হয় – চৈত্র নবরাত্রি এবং শরদ নবরাত্রি। প্রতিটি দিন মা দুর্গার এক একটি রূপের পূজা করা হয়। এই সময়ে ভক্তরা উপবাস পালন করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

রথযাত্রা উৎসবটি জগন্নাথ দেবের সম্মানে উদযাপিত হয়। পুরীতে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দির থেকে বিশাল রথে করে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা দেবদেবীদের মূর্তি নিয়ে যাত্রা করা হয়। এই উৎসবে লক্ষ লক্ষ ভক্ত অংশগ্রহণ করেন এবং রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার পবিত্র দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া সনাতন ধর্মে আরও অনেক উৎসব রয়েছে, যেমন মকর সংক্রান্তি, গণেশ চতুর্থী, রাখি বন্ধন, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি। প্রতিটি উৎসবের পেছনে রয়েছে গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য, যা সনাতন ধর্মের ভক্তদের জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

আধুনিক যুগে সনাতন ধর্মের প্রভাব ও পরিবর্তন

আধুনিক যুগে সনাতন ধর্মের প্রভাব এবং পরিবর্তন উল্লেখযোগ্যভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সনাতন ধর্ম তার প্রচীন ঐতিহ্য ও সংস্কারকে বজায় রেখে আধুনিক সমাজের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এই ধর্ম বৃহত্তর বিশ্বে তার স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষ করে প্রযুক্তির উন্নতি ও ডিজিটাল যুগের প্রসারের মাধ্যমে।

প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সনাতন ধর্মের শিক্ষা ও আচার-অনুষ্ঠানগুলি এখন আরো সহজলভ্য হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি ধর্মীয় গ্রন্থ, উপাসনা, এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলি সরাসরি সম্প্রচার করছে, যা প্রচীন প্রথাগুলির সাথে আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। ভার্চুয়াল উপাসনা ও ধর্মীয় আলোচনা গ্রুপগুলি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একত্রিত হওয়ার একটি নতুন পথ খুলে দিয়েছে।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং গবেষণার মাধ্যমে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ চলছে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত সমাজ এই ধর্মের বিভিন্ন দিককে গবেষণা ও পুনর্মূল্যায়ন করছে, যার ফলে সনাতন ধর্মের পুরাতন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি সমন্বয় তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সনাতন ধর্মের ওপর বিভিন্ন কোর্স ও গবেষণা প্রকল্প চালু হয়েছে, যা এই ধর্মের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।

আধুনিক যুগে সনাতন ধর্মের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও যথেষ্ট। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম ও উৎসবের মাধ্যমে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সমাজে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এনজিওরা সনাতন ধর্মের আদর্শ ও শিক্ষা প্রচার করছে, যা সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এইভাবে, আধুনিক যুগে সনাতন ধর্ম তার প্রভাব ও পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজে তার অবস্থান বজায় রেখেছে এবং প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে নিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী সনাতন ধর্মের প্রচার ও সম্প্রসারণ

সনাতন ধর্মের প্রচার ও সম্প্রসারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়েছে, যা সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলেছে। সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা ও দর্শন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে সেখানে অনেক হিন্দু মন্দির ও সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৬০-এর দশকে হরে কৃষ্ণ আন্দোলন (ISKCON) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সনাতন ধর্মের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আজ, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে অসংখ্য হিন্দু মন্দির ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। এখানকার হিন্দু সম্প্রদায় নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের আয়োজন করে থাকে।

যুক্তরাজ্যে সনাতন ধর্মের সম্প্রসারণের সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে। বর্তমানে, লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে হিন্দু মন্দির ও ধর্মীয় সংস্থা রয়েছে। এখানকার হিন্দু সম্প্রদায় স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও সনাতন ধর্মের অনুগামীরা বসবাস করেন। এইসব দেশে হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেমন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, এবং ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি সুপ্রাচীন। এখানে হিন্দু ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলি ব্যাপকভাবে পালিত হয়।

বিশ্বব্যাপী সনাতন ধর্মের সম্প্রসারণের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু ও সংগঠনের প্রচেষ্টা। তাদের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা, যোগ, এবং আধ্যাত্মিকতার প্রচার হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করে চলেছেন।